বাংলাদেশে জঙ্গিতৎপরতা ও করণীয় -মাহমুদুল বাসার
আপডেটঃ 2:12 am | January 22, 2017

ব্যাপারটি লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশ পাকিস্তান সহ মধ্য প্রাচ্য এবং অধিকাংশ মুসলিম দেশ গুলোতে ধর্মের নামে তথা ইসলামের নামে জঙ্গি তৎপরতা সর্বাধিক। সে তুলনায় অন্যান্য অমুসলিম দেশে এমন মারমুখো জঙ্গি তৎপরতা নেই। এর মূল কারণ মুসলিম প্রধান দেশ গুলোতেই ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার, রাষ্ট্রকে ধর্ম ভিত্তিক করার ঝোঁক বেশি। অতি সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাদ বলেছেন, ‘এটা সত্য যে, ইসলাম নিয়ে সমস্যা আছে। এব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এটা বিপজ্জনক ধর্ম, সে হিসেবে ইসলাম সমস্যা নয়। তবে এটা রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাতেই সমস্যা।’
খুবই মৌলিক বক্তব্য। ইসলামের ইতিহাসে দীর্ঘকালের গোত্রদ্বন্দ আছে। সেই গোত্রদ্বন্দ¦ এখন শিয়া-সুন্নীর রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ রূপ নিয়েছে। আমাদের দেশ পাকিস্তানের কাঠামো থেকে বের হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে একটি আধুনিক-ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টি ভঙ্গিঁতে। পাকিস্তান এখনো একটি মোল্লাতান্ত্রিক, অনুন্নত রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে তালেবানের দৌরাতœ্য বজায় আছে। এবং পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে একটি পিছিয়ে পড়া দেশ।
বাংলাদেশে ২০০১ সালের পর জঙ্গিঁ তৎপরতা মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে বাংলা ভাই ও শায়খ রহমানেরা উত্তর বঙ্গে একটি জঙ্গি-মিনি রাষ্ট্র কায়েম করেছিলো। তৎকালীন প্রশাসন তাদের প্রশয় দিয়েছে। বাংলা ভাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের হত্যা করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখতো। গনমাধ্যম ও সাংবাদিকরা বার বার তৎকালীন সরকারকে সর্তক করেছিলো, জঙ্গি দমনের পরামর্শ দিয়েছিলো। কিন্তু সরকার বললো, ‘বাংলা ভাই বলে কেউ নেই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি।’ এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, যদি খোদ রাষ্ট্র ও তার প্রশাসন জঙ্গি প্রশ্রয় দেয় তাহলে সে রাষ্ট্রে নিরাপদে নির্বিঘেœ জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ প্রসারিত হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পেছনে পড়েছে আর ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি শেকড় মেলেছে। এরপর ২০০১ সালের পর সরাসরি জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জঙ্গি ও সন্তাসীরা এদেশের মেধাবী বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, অনেক মেধাবী তরুণের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে; নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ২০১৬ সালের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা গুলশানের হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের হত্যাকান্ড। অকারণ উল্লাসে তারা ২০ জন বিদেশি নাগরিককে গলা কেটে হত্যা করেছে। এমন পাশবিক ঘটনা ঘটানোর সময়ও তারা ধর্মের দোহাই দিয়েছে। মাথায় পাগড়ি দিয়ে দাঁত বের করে হেসেছে। মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে, ঘৃণায় কুচকে গেছে ওদের হাসি দেখে।
এর পরপরই ২০১৬ সালের পবিত্র ঈদের দিন শেলোকিয়ায় জঙ্গিরা বোমা ছুড়ে মেরেছে। এতে কয়েকজন হতাহত হয়েছে। একজন পুলিশ প্রাণ হারিয়েছেন। গুলশানেও একজন পুলিশ অফিসার প্রাণ হারিয়েছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক বলেছেন, জঙ্গি দমনে পুলিশ অনেক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না। জঙ্গি দমনে আইনের শাসনের দ- যথাযথ খাড়া রাখতে হবে, এর কোনো শৈথিল্য দেখানো চলবে না। কিন্তু পুলিশি অভিযানই জঙ্গি দমনে একমাত্র পন্থা নয়; এ কথা আইজিপিও বলে থাকেন। তিনি যে বার বার একাধিক বক্তৃতায় জনগনের সহ-যোগিতা চেয়ে থাকেন, এর গুরুত্ব আছে। জনগণের শক্তি বড় শক্তি। আইনের পাশাপাশি জনগনের ভেতরে জঙ্গি বিরোধী চেতনা প্রখর ভাবে জাগিয়ে তোলা দরকার। এই কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন। এই সেদিনও তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের সময়, বাংলাদেশের জনগণকে সর্তক করে বলেছেন, ‘আপনাদের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখবেন যেন তারা বিপজ্জনক পথে যাবার সুযোগ না পায়।’ প্রধানমন্ত্রীর কথার গুরুত্ব বুঝতে হবে। পরিবারেই সবসময় চর্চা হওয়া উচিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে ধর্মের পার্থক্যটি কোথায়। প্রতিটি পরিবারে আলোচনা হওয়া উচিত, জঙ্গিরা যে আত্মহত্যা করছে, এটাতো মহাপাপ। নর হত্যাও মহাপাপ, এ কথা বার বার পরিবারে আলোচনা করলে তার ফল পাওয়া যাবে। আইনের শাসন অমান্য করে আইন হাতে তুলে নিয়ে মানুষ হত্যা কোনো ধর্মীয় অনুশাসনের নির্দেশ হতে পারে না। তবে এটা ঠিক যে অতীতের তুলনায় বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অনেকটা জঙ্গীবিরোধী মনোভাব জেগেছে। তাই লক্ষ্য করেছিলাম, সারাদেশে বিভিন্ন স্তরের লোকজন জঙ্গি বিরোধী মানববন্ধন করেছে। আমরা মনে করি, দেশব্যাপী জঙ্গি বিরোধী আন্দোলন হওয়া দরকার এবং তা অব্যাহত রাখা দরকার।
আমরা লক্ষ্য করেছি, সারা বছর ধরে সরকারি পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় আঘাত হেনেছে, তাতে সফল হয়েছে। ইংরেজীতে কথা আছে। ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর।’ জনগণ যদি জঙ্গি বিরোধী হয় তাহলে জঙ্গি আস্তানাই গড়ে উঠতে পারবে না।
শোলাকিয়ার ইমাম আল্লামা ফরিদ উদদীন মাসউদ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যে ফতোয়া দিয়েছেন, তার সরল ব্যাখ্যা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। জঙ্গি দমনে জোরের চেয়ে কৌশল ও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। ধর্মের অনুশীলন বাড়াতে হবে, বেকারত্ব ঘোচাতে হবে। কেননা দেশের বেকার ছেলেমেয়েদের কাজে লাগিয়ে থাকে জঙ্গিরা। সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে হবে। সংস্কৃতির প্রভাব ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার দূর করে। অন্ধবিশ্বাস ধর্মীয় মূল্যবোধ নয় তা বোঝাতে হবে বর্তমান প্রজন্মকে। ইসলাম মানবতা থেকে দূরে নয়, তা সরল প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝাতে হবে। তাহলেই জঙ্গিবাদ দূর হবে।
মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।